সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া না করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৮ রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।
দলগুলো নিয়ে আজ একই স্থানে শুরু হবে সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ। প্রথম দিনে ৭০ অনুচ্ছেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, সংসদের নিম্নকক্ষে নারী আসনের নির্বাচন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হবে।
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে গতকালের বৈঠক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, সিপিবি, বাসদ, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্তত ৯টি দল একই দাবি জানিয়েছে।
অন্য অনেক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে রাজি। এর আগেই সংস্কার সম্পন্ন হতে হবে– এ শর্ত দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, জুলাই সনদ সই হওয়ার পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়সূচি, অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনকে সমর্থন জানিয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল ও জোটের ৩৪ প্রতিনিধির ২৬ জন বক্তৃতা করেন। বিকেল ৪টায় শুরু হয়ে আড়াই ঘণ্টা চলে বৈঠক।
সুযোগ যেন হারিয়ে না যায়
প্রধান উপদেষ্টা নিজেই ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি। তিনি বৈঠকের শুরুতে বলেন, ‘এখানে সবাই মিলে বাংলাদেশের প্রকৃত ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হচ্ছে; সংস্কারকে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে গাইড করবে, কোথায় নিয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সংস্কারের। প্রথমে ছয়টি কমিশনকে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। এর পর ঐকমত্য গঠনে আলাদা কমিশন করা হলো। তা ফলপ্রসূ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর আনন্দসহ সহযোগিতায়। সবাই বসলে নিশ্চয় ভালো কিছু আসবে। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে জুলাই সনদ করব।’
দ্বিতীয় পর্বে কী হবে, তা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, অনেক বিষয়ে আমরা কাছাকাছি এসে গেছি। আরেকটু হলেই ঐকমত্যের তালিকায় আরেকটি সুপারিশ যুক্ত হয়; এ সুযোগ যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। যেটুকু দূরত্ব ছিল, তা ঘুচিয়ে এনে যত ঐকমত্যের বিষয় আছে, তাতে যেন আরও কিছু যোগ করতে পারি। জাতীয় একটি সনদ হবে। জাতি হিসেবে গর্বিত হিসেবে যেন দাঁড়াতে পারি। বিভক্তীকরণের রাজনীতি সৃষ্টি নয়; দেশের উন্নয়ন-মঙ্গলের জন্য, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, যাতে চমৎকার একটি জুলাই সনদ করতে পারি। সমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মূল জিনিস হলো ঐক্য ধরে রাখা, যাতে জুলাই সনদ সমৃদ্ধ করতে পারি। জাতি যেন দেখতে পারে, যারা এখানে আছি, তারা কী কী বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদি ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। গতকালের বৈঠকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “কমিশনের মেয়াদ আগস্টে শেষ হচ্ছে। এর আগেই জুলাই মাসে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করতে কমিশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পবিত্র দায়িত্ব পালনে অবশ্যই সফল হতে হবে।”
দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ আজ
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুদক সংস্কার কমিশনের ১৬৬ সুপারিশ বিষয়ে ৩৮ রাজনৈতিক দল এবং জোটের কাছে মতামত চাওয়া হয় গত মার্চে। প্রথম ধাপের সংলাপে মতামত দেওয়া ৩৩ দল এবং জোটের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ৪৫টি বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে সংলাপ করে কমিশন।
কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে সব রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা হবে। কমিশন দলগুলোকে কাছাকাছি এনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে।
কমিশন ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলের প্রস্তাব করে সুপারিশ করেছিল। এমপিরা অর্থ বিল বাদে অন্য বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। তবে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কোনো দল এতে রাজি হয়নি। দলগুলো চায়, এমপিরা সংবিধান সংশোধন এবং আস্থা-অনাস্থা প্রস্তাবে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। বিএনপি চায়, এমপিরা জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নেও দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। দ্বিতীয় ধাপের প্রথম দিনে আজ এসব নিয়ে আলোচনা হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সর্বোচ্চ ১২০ দিন মেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছে। বিএনপি চায়, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে ৯০ দিন মেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতো, একই পদ্ধতি ফিরুক আদালতের রায়ে। জামায়াতও চেয়েছিল সর্বশেষ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের আগের পদ্ধতির তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসুক। তবে দলটি বিচার বিভাগকে দূরে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিকল্প প্রস্তাব দিতে রাজি হয়েছে। বিএনপি বলেছে, কমিশন বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে। এনসিপি চেয়েছে, সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হোক। ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলও তত্ত্বাবধায়ক নয়; নির্বাচনকালীন সরকার চেয়েছে।
এ ছাড়া আজ আলোচনা হবে সংসদে নারী আসন নিয়ে। কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৪০০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদের ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল রাজি না হলেও এনসিপি এতে একমত।
বৈঠকে দলগুলো যা বলল
সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আগের দিনগুলোর তুলনায় গতকাল নমনীয় ছিলেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবি জানান। আবারও বলেন, বিএনপি সংস্কারের বিরুদ্ধে নয়।
এর আগে কয়েকটি দলের নেতা বক্তৃতায় বলেন, ভারত দ্রুত নির্বাচনের কথা বলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। সরকার কেন ভারতের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করছে না? সালাহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে নিজের বক্তৃতার সময় বলেন, ‘এক সময় যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলত। তখন তো কেউ সমালোচনা করত না। ভারত নির্বাচনের কথা বললে কেন সমালোচনা করতে হবে?’ তাঁর এ বক্তব্যে বৈঠকে হাস্যরস হয়। ভারতের সমালোচনায় বিএনপি কেন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে– প্রশ্ন তোলা হয়।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদ এবং ঘোষণাপত্রের আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত হবে না। জুলাইয়ের মধ্যে সনদ সই করে আগামী ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা যেতে পারে।
বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, সংস্কারের কিছু সুপারিশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন শুরু করেছে। পরে রাজনৈতিক দলের নেতারা এর জবাবে বলেন, সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে– এমন কিছু তারা দেখেননি।
‘এক মাসের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব’
বৈঠকের পর সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এমন সংস্কার নেই, যা এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় অনেক সংস্কার করেছে অধ্যাদেশের মাধ্যমে। সংবিধান সংশোধন বাদে যেসব সংস্কারে সব দল একমত হবে সেগুলোও অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব। সুতরাং নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে আয়োজনের কারণ নেই– এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করে ঐকমত্যের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা দরকার। বৈঠকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টার। তিনি বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। আমরা মনে করি, তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নিরপেক্ষভাবে সেই ভূমিকা পালন করবেন। কারও প্রতি রাগ-বিরাগ প্রদর্শন করবেন না।