প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেড় ঘণ্টার বৈঠককে ইতিবাচক বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শুক্রবার লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে ৯০ মিনিটের এই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সৃষ্ট সংকট বা আস্থার ঘাটতি কেটে যাবে বলেও মনে করেন তারা।
বৈঠকে আলোচনার যতটুকু সামনে এসেছে তা ইতিবাচক। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করার কারণে ভুল বোঝাবুঝিও হয়তো কেটে গেছে। তবে দুই নেতার মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, ভবিষ্যতে তা যেন ভেঙে না যায় বা সেই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আলোচনা হওয়াটাই তো ইতিবাচক বিষয়। ফলে এই বৈঠক অবশ্যই ইতিবাচক। এছাড়া তারা (সরকার) তো নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। কারণ প্রথমে তিনি (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) জুনে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পরে আবার বলেছেন এপ্রিলের কথা। এখন বলছেন, সংস্কার শেষ হলে আর বিচার দৃশ্যমান করতে পারলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে উনার কোনো আপত্তি নেই। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। আর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করার কারণে ভুল বোঝাবুঝিও হয়তো কেটে গেছে। তাদের আলোচনার সবকিছু তো আমরা জানতে পারব না। তবে যতটুকু সামনে এসেছে এটা ইতিবাচক।
তিনি আরও বলেন, আমরা তো আগে থেকেই বলে আসছি বিচার সব কাজ সম্পূর্ণ করা সময়সাপেক্ষ। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সংস্কারও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ফলে প্রধান সংস্কার কাজ যদি শেষ করা যায় বা একমত হলে তো নির্বাচন করতে কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া সংস্কার বাস্তবায়ন তো এই সরকারের হাতেও নেই। সংস্কার একটি পলিসিগত দিক। ফলে সেগুলো নিয়ে ঐকমত্য হলে তো ফেব্রুয়ারির দরকার নেই। এটা আগামী মাসেও হতে পারে। আর এটা যদি হয়ে যায়, বিচারের কিছু কাজ যদি দৃশ্যমান হয় তাহলে তো নির্বাচন অনুষ্ঠানে কারও কোনো আপত্তি নেই। তাছাড়া নির্বাচনকে কোনোভাবেই সংস্কার ও বিচারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এটা তো পরিষ্কার সরকার ও বিএনপির মধ্যে কিছুটা টেনশন তৈরি হয়েছিল। ফলে তারা যখন বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটাই ইতিবাচক ছিল। এরপর যে বৈঠক হলো এতে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করি টেনশন ও সংকটটা দূর হবে। আমাদের এই শক্তি যদি পরস্পরের সঙ্গে ফাইট করতে থাকে তাহলে দেশে অস্থিরতা তৈরি হওয়া ছাড়া কোনো লাভ হবে না। দুপক্ষই এটা বুঝতে পেরেছে। তারা বসেছেন, পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আমার ধারণা দুপক্ষই একে অন্যের কিছু দাবি মেনেও নিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে তারা একটি মাঝামাঝি জায়গায় এসেছেন। ‘ইটস এ ভেরি গুড সাইন।’ আশা করি এগুলো ঠিকঠাকমতো চলবে।
তিনি আরও বলেন, তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে কিন্তু এনসিপি প্রশ্ন তুলছে। এখন নির্বাচন কমিশন একটা শিডিউল দিলে সেটা তারা মানল না। তারা যদি আবার কোনো মুভমেন্ট করে, ফলে অনিশ্চয়তা যে পুরো চলে গেছে সেটা আমি বলছি না। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এটা (বৈঠক) একটা সমাধানের দিকে যাওয়ার পথ তৈরি করল। সব মিলিয়ে এই বৈঠক ইতিবাচক বললেও সতর্ক থাকা উচিত বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, ইউনূস সরকারের মধ্যে অনেক পাওয়ার সেন্টার আছে বলে আমি মনে করি। তাদের আচরণে মনে হয়েছে তিনি এককভাবে নয়, অনেক দিক থেকে অনেকে পাওয়ার প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করে। ফলে ভবিষ্যতে উনার এই চিন্তা বা দুজনের মধ্যে এই যে সমঝোতা এটা যেন ভেঙে না যায় বা সেই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, দেশের মানুষ এই ধরনের একটা বৈঠক প্রত্যাশা করেছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অরাজনৈতিক। তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নেবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ফলে এই ধরনের বৈঠক হওয়া ভালো। এছাড়া এই বৈঠকটি তিনি (ড. ইউনূস) এমন একটা সময়ে করলেন যখন নির্বাচনের তারিখ নিয়ে একটা সংকট চলছিল। বিএনপি আগেই বলেছিল তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। আর ড. ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন নির্বাচন হবে এপ্রিলের প্রথমার্ধে। ফলে এই বিরোধ নিয়ে এই ধরনের বৈঠক খুব কার্যকর হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি এই ধরনের বিরোধ তো হওয়ারই কথা ছিল না। তিনি আলাপ করেই নির্বাচনের তারিখ দিতে পারতেন। এই বিষয়গুলো তার অপরিপক্বতার প্রকাশ ছিল। আবার এটা চালাকিও হতে পারে। এখন ফেব্রুয়ারির কথা বললেও এখানে কিন্তু অনেক ‘ইফ এবং বাট’ আছে। কিছু অস্পষ্টতা আছে। তবে যে কোনো বৈঠক বা আলোচনা সব সময়ই ইতিবাচক বলেও মনে করেন এই সিনিয়র সাংবাদিক।