চলতি শতকের শুরুর দিককার কথা। বিংশ শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ক্রিকেটারের খোঁজ চলছে উইজডেনে। শেষ পর্যন্ত তিন জনে নেমে এল সংখ্যাটা। শচীন টেন্ডুলকার, সুনীল গাভাস্কার আর কপিল দেব। পরিসংখ্যানে শুরুর দুই ক্রিকেটারের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন কপিল, ভারতীয় ক্রিকেটে রথী মহারথীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না। তবু কপিলই বনে গিয়েছিলেন গেল শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ক্রিকেটার, পরিসংখ্যানে আর সবার চেয়ে পিছিয়ে থেকেও।
কেন জিতলেন? সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, চোখ বোলাতে হবে কপিল দেবের ক্যারিয়ারেও। ভারতীয় ক্রিকেটে গেল শতাব্দীতে তার চেয়ে বড় প্রভাব যে আর কেউই রাখতে পারেননি!
তাকে ডাকা হতো ‘হরিয়ানা হারিকেন’ নামে। এই উপাধি শুধু তার জন্মস্থান হরিয়ানার কারণে নয়, এ উপাধি তিনি পেয়েছেন তার শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও খেলার ধরনের কারণেও। মাঠে এবং মাঠের বাইরে, কপিল ছিলেন এক শক্তিশালী ঝড়ের মতো।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি, চণ্ডীগড়ে। খুব অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। হরিয়ানা রাজ্যের মানুষের পরিশ্রমী ও দৃঢ়চেতা বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারত জুড়ে খ্যাতি আছে। কপিলও ছিলেন তার এলাকার মানুষের মতোই, কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাসী এবং অসম্ভবকে সম্ভব করা, কখনও হাল ছেড়ে না দেওয়া মানুষদের দলে।
তার বোলিং ছিল গতিময়, আগ্রাসী এবং নিখুঁত। তিনি বল সুইং করাতে পারতেন দারুণভাবে। ইন-সুইং আর আউট-সুইং দিয়ে তিনি বিভ্রান্ত করতেন ব্যাটারদের। তার বোলিং অ্যাকশন ছিল মসৃণ, কিন্তু তাতে ছিল এক ধরণের আগ্রাসী ছন্দ। তিনি টানা অনেক ওভার বল করতে পারতেন, কারণ তার ফিটনেস ও মানসিক দৃঢ়তা ছিল অসাধারণ।
তবে শুধু বলেই নয়, ব্যাট হাতেও কপিল ছিলেন বিধ্বংসী। নিচের দিকের ব্যাটার হয়েও তিনি ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতেন কয়েক ওভারের মধ্যে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার ১৭৫ রানের সেই বিখ্যাত ইনিংসকে ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা এক ইনিংস হিসেবে ধরা হয় এখনও। এই ইনিংসটাই প্রমাণ করে, একাই কীভাবে তিনি একটি ম্যাচ বদলে দিতে পারেন।
তিনি শুধুমাত্র ভালো খেলোয়াড় হলে ওই শতাব্দীর সেরার দৌড়ে আসতেন না। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত নেতা, তাই আর সবার চেয়ে আলাদা করে দেয় তাকে। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে তিনি ভারতের অধিনায়ক ছিলেন। সেই সময় কেউ বিশ্বাস করত না ভারত বিশ্বকাপ জিততে পারে।
কেউ বলতে খোদ তার দলেও তো অবিশ্বাস ছিল ভারি! তাদের ম্যানেজার মান সিং লর্ডসে ঢোকার অনুমতি আনতে পারেননি দলের, খুব একটা চেষ্টাও করেননি, তার আগেই দলের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যাবে ভেবে। এমনকি কেটে রেখেছিলেন দেশে ফেরার টিকিটও। দলের ভেতরেই যখন বিশ্বাসটা হবে এমন, বাইরের কারও যে বিশ্বাস থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য!
বিশ্বকাপের আগে প্রিভিউতে বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রিথ তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারা যদি গ্রুপ পর্ব পেরোয়, তাহলেও আমি আমার কথাগুলোকে চিবিয়ে খাব।’ কপিল সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বসে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপ জেতার ইচ্ছাই যদি না থাকে, তাহলে এখানে আসা কেন?’
সে কথার পর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিতল ভারত, এরপরও বিশ্বাসটা ছড়িয়ে পড়েনি ভেতরে। ডাবল লিগ পদ্ধতির গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় লেগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল রীতিমতো বাঁচা মরার লড়াই। সে ম্যাচে খাদের কিনারেই চলে গিয়েছিল ভারত। সেখান থেকে কপিলের ১৭৫ রানের ইনিংস দলকে এনে দেয় বড় পুঁজি, যা হাতে নিয়েই শেষমেশ ম্যাচটা জেতে দলটা। সেই এক ম্যাচই দলকে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় বিশ্বজয়ের।
তবে সে আত্মবিশ্বাসের ঘুড়ি ফাইনালে গিয়ে ভোকাট্টা হওয়ার যোগাড়ই হয়েছিল। ১৮৩ রানে অলআউট হলো ভারত। এ রান নিয়ে আর যাই হোক বিশ্বকাপের ফাইনালে জেতেনি কোনো দল। উইন্ডিজ জবাবে শুরুটাও করেছিল ভালো। ঝড়ের বেগে এগোতে থাকা ভিভ রিচার্ডস যেই না একটা সুযোগ দিলেন, কপিল দেব সেটাই লুফে নিলেন। সেই একটা উইকেটই মোড় ঘুরিয়ে দিল ওই ফাইনালের। শেষমেশ ৪৩ রানের জয় নিয়ে ভারত শেষ হাসিটা হাসে।
সে বিশ্বকাপ তো বটেই, বিশ্বকাপের আগে পরে তিনি মাঠে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার আত্মবিশ্বাস, আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং স্মার্ট নেতৃত্ব মিলিয়ে গিয়েছিল এক দুর্দান্ত কৌশলের সঙ্গে। সেই বিশ্বকাপ জয় শুধু ট্রফি জেতা ছিল না, ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য এক বিপ্লব।
বিপ্লবই বটে। সে বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ভারত শুধু একটা বিশ্বকাপ ম্যাচই জিততে পেরেছিল, যারা আবার ‘৮৩ বিশ্বকাপে খেলেওনি। এমন একটা দল নিয়ে বিশ্বকাপ জিতে যাওয়া, বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন করে জায়গা করে নেওয়াটা বিপ্লব নয়তো কী?
সে বিপ্লবই যে ভারতকে বদলে দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের দর্শনে তার প্রভাব প্রবল। কপিল-পূর্ব আর পরবর্তী যুগে ভারতের বদলটাও খুব পরিষ্কার। আর সে বদলের মূলে ছিল ৮৩’র সে বিপ্লব।
আর সে বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কপিল দেব। তাই আজও ভারতের ক্রিকেট তাই তাকে কুর্নিশ করে শ্রদ্ধাভরে।